মুক্তাক্ষর সব ছন্দেই একমাত্রা হওয়ায় বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনা ভেদে বাংলা ছন্দ রীতিতে বিভেদ ঘটে ৷ বাংলা কবিতার ছন্দ সাধারনত তিন ধরনের ৷ যেমনঃ— ১. স্বরবৃত্ত ২. মাত্রাবৃত্ত ৩. অক্ষরবৃত্ত
১। স্বরবৃত্ত : যে ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় একমাত্রা ধরা হয় এবং পর্বের আদিতে স্বাসাঘাত পড়ে তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে৷ স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্টঃ
ক. এ ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় এক মাত্রা ধরা হয় ৷
খ. এ ছন্দে প্রতিটি চরণ সাধারণত চারটি পর্বে বিভক্ত এবং প্রতিটি পর্বের সংখ্যা চার ৷
গ. কোথাও কোথাও তিন বা দইুমাত্রা বিশিষ্ট পর্বও পূর্ণ পর্বের মর্যাদা লাভ করে ৷ অর্থাৎ শেষের পর্বটি প্রায়ই অপূর্ণ পর্ব থেকে যায়।
ঘ. এছন্দের পর্ব গুলো সংক্ষিত হয়।
ঙ. এছন্দ তুলনা মূলক দ্রুতলয়।
চ. এ ছন্দ টেনে পড়তে হলে কখনো কখনো বদ্ধাক্ষর দুই মাত্রা হিসেবে ধরা হয়।
ছ. এ ছন্দের মূল ছড়ার ছন্দে নিহত ৷
জ. এ ছন্দে সাধুরীতির ক্রিয়াপদ কম ব্যবহৃত হয়।
ঝ. মৌখিক তাজা রসের জন্য এ ছন্দ ব্যবহার করা হয় ৷
এছন্দে পূর্ণ পর্বের ওজন সমতা সর্বদা সমান থাকে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: (কলাবৃত্ত বা ধ্বনিপ্রধান ছন্দ) বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত প্রধান তিনটি ছন্দের একটি। অন্য দুটি হলো স্বরবৃত্ত ছন্দ এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর মূলপর্ব ৪, ৫, ৬, ৭ মাত্রার হতে পারে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বৈশিষ্ট্য
১। মূল পর্ব ৪,৫,৬ বা ৭ মাত্রার হয়।
২। অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়; আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে (য় থাকলেও) ২ মাত্রা গুনতে হয়; য় থাকলে, যেমন- হয়, কয়; য়-কে বলা যায় semi-vowel, পুরো স্বরধ্বনি নয়, তাই এটি অক্ষরের শেষে থাকলে মাত্রা ২ হয়।
৩। কবিতা আবৃত্তির গতি স্বরবৃত্ত ছন্দের চেয়ে ধীর, কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চেয়ে দ্রুত।
ছন্দ বিশ্লেষণ
এইখানে তোর / দাদির কবর / ডালিম-গাছের ∣ তলে ৬+৬+৬+২
তিরিশ বছর / ভিজায়ে রেখেছি / দুই নয়নের ∣ জলে ৬+৬+৬+২
(কবর; জসীমউদদীন)
কবিতাটির মূল পর্ব ৬ মাত্রার। প্রতি চরণে তিনটি ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব এবং একটি ২ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব আছে।
এখন মাত্রা গণনা করলে দেখা যাচ্ছে, প্রথম চরণের-
প্রথম পর্ব- এইখানে তোর; এ+ই+খা+নে = ৪ মাত্রা (প্রতিটি অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা); তোর = ২ মাত্রা (অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় ২ মাত্রা)।
দ্বিতীয় পর্ব- দাদির কবর; দা+দির = ১+২ = ৩ মাত্রা; ক+বর = ১+২ = ৩ মাত্রা।
তৃতীয় পর্ব- ডালিম-গাছের; ডা+লিম = ১+২ = ৩ মাত্রা; গা+ছের = ১+২ = ৩ মাত্রা।
চতুর্থ পর্ব- তলে; ত+লে = ১+১ = ২ মাত্রা।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ (মিশ্রকলাবৃত্ত/তানপ্রধান ছন্দ) বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত প্রধান তিনটি ছন্দের একটি। অন্য দুটি হলো স্বরবৃত্ত ছন্দ এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর মূলপর্ব সাধারণত ৮ বা ১০ হয় । এছাড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ৮+৮, ৮+৬, ৮+৪, ৮+২ হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য
১। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়।
২। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, যুক্তাক্ষর শব্দের প্রথমে ও মাঝে ১ মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর ২ মাত্রা।
৩। অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়।
৪। অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়; শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা হয়।
৫। কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে, এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, সেই অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়।
৬। কোন সমাসবদ্ধ পদের শুরুতে যদি এমন অক্ষর থাকে, যার শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, তবে সেই অক্ষরের মাত্রা ১ বা ২ হতে পারে।
৭। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখা কবিতার আবৃত্তি ধীরগতি হয়।
ছন্দ বিশ্লেষণ
• হে কবি, নীরব কেন/ফাগুন যে এসেছে ধরায় ৮+১০
• বসন্তে বরিয়া তুমি/লবে না কি তব বন্দনায় ৮+১০
• কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি- ১০
• দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? ১০
(তাহারেই পড়ে মনে; সুফিয়া কামাল)
কবিতাটির মূল পর্ব ৮ ও ১০ মাত্রার। স্তবক দুই পর্বের হলেও এক পর্বেরও স্তবক আছে।
এখন, মাত্রা গণনা করলে দেখা যায়,
• প্রথম চরণের,
প্রথম পর্ব- হে কবি, নীরব কেন; হে কবি- হে+ক+বি = ৩ মাত্রা (তিনটি অক্ষরের প্রতিটির শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা); নীরব- নী+রব = ১+২ = ৩ মাত্রা (শব্দের শেষের অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় সেটি ২ মাত্রা); কেন- কে+ন = ১+১ = ২ মাত্রা; মোট ৮ মাত্রা।
• আবার দ্বিতীয় চরণের,
দ্বিতীয় পর্ব- লবে না কি তব বন্দনায়; লবে- ল+বে = ২ মাত্রা; না কি তব = না+কি+ত+ব = ৪ মাত্রা; বন্দনায়- বন+দ+নায় = ১+১+২ = ৪ মাত্রা (বন- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলেও অক্ষরটি শব্দের শেষে না থাকায় এর মাত্রা ১ হবে; আবার নায়- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি- য় থাকায়, এবং অক্ষরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা হবে ২; মোট ১০ মাত্রা।
অক্ষর বৃত্ত ছন্দ এর উদাহরণ কবিতা ছন্দ বিশ্লেষন…..
• সকালে উঠিয়া আমি/ মনে মনে বলি,
• সারাদিন আমি যেন/ ভাল হয়ে চলি।
• আদেশ করেন যাহা/ মোর গুরুজনে,
• আমি যেন সেই কাজ/ করি ভাল মনে।
• ভাইবোন সকলেরে /যেন ভালবাসি,
• এক সাথে থাকি যেন /সবে মিলেমিশি।
• ভাল ছেলেদের সাথে /মিশে করি খেলা,
• পাঠের সময় যেন /নাহি করি হেলা।
• সুখী যেন নাহি হই /আর কারো দুখে,
• মিছে কথা কভু যেন/ নাহি আসে মুখে।
• সাবধানে যেন লোভ /সামলিয়ে থাকি,
• কিছুতে কাহারে যেন/ নাহি দেই ফাঁকি। ঝগড়া না করি যেন/ কভু কারো সনে,
• সকালে উঠিয়া এই /বলি মনে মনে।।
• অক্ষর বৃত্ত ৮✝৬,, কবিতা মদন মোহন …..তর্কালঙ্কার